রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৬ অপরাহ্ন
মো. মিকাইল আহমেদ:
বর্ণবাদের কোনো স্থান ইসলামে নেই। বর্ণবৈষম্য মানবতা বিবর্জিত এক জঘন্য অপরাধ যা ইসলাম বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে অাসছে। মানুষে মানুষে বর্ণবৈষম্যের ভেদাভেদ ভুলে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের অনুপম বার্তা নিয়ে সকলকে এক কাতারে সহাবস্থানের আহ্বান জানায় ইসলাম। দ্বীন হিসেবে ইসলামই সর্বপ্রথম বর্ণবৈষম্যের মূলে কুঠারাঘাত করেছে অার প্রতিষ্ঠা করেছে শান্তির ধর্ম যা কেউ মসজিদে নামাজের কাতারে কিংবা পবিত্র হজ্জ্বের সময় হজ্জ্বব্রত পালনের জন্য মক্কায় অবস্থানরত হাজীগণের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বুঝতে পারবেন সহজেই। অার এখানেই শান্তির ধর্ম ইসলামের মূল সৌন্দর্য্য নিহিত।
বর্ণবৈষম্য এমন দৃষ্টিভঙ্গি যার মাধ্যমে বিশ্বাস করা হয় কোনো কোনো গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উঁচু অথবা নিচু; বেশি যোগ্য কিংবা অযোগ্য বলে বিবেচিত; কিংবা তার উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী। ১৯৩০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের উৎপত্তি। দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকাতে সর্বপ্রথম বর্ণবাদ শব্দের উৎপত্তি হয় এবং নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ ক্ষমতা দখল ও পেশী শক্তির প্রদর্শনী চলে। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিবাসীদের কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ, দক্ষিণ এশীয়, বর্ণসংকর ইত্যাদি বর্ণে ভাগ করে শেতাঙ্গ শাসিত সরকার আইন করে যার ফলে অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত জনপদ আফ্রিকায় সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী মূল ধারার সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে।
বর্ণবৈষম্য শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ এর মধ্যকার এক অলিখিত যুদ্ধ। অার যুগ যুগ ধরে চলছে এ যুদ্ধের মহারণ। ক্ষণে ক্ষণে বেজে ওঠে এ যুদ্ধের দামামা। কখনো কখনো মনে হয় এ যাবৎ কাল পৃথিবীতে সংঘটিত সকল যুদ্ধের ভয়াবহতাকে ছাড়িয়ে যায় বর্ণবাদের এ যুদ্ধ। কারণটা যে সহজেই অনুমেয়। কি এক তুচ্ছ কারণে শতাব্দীর পর শতাব্দী চলছে বর্ণবাদের এ নোংরা খেলা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও শেষ হয়ে গেছে কবেই। বর্ণবৈষম্যের এ যুদ্ধ কবে নাগাদ শেষ হবে তা কেউ বলতে পারেনা। অাদৌ শেষ হবে কিনা সেটাও কেউ জানেনা। পৃথিবী অাধুনিক হয়েছে বটে। অন্ধকার গোহার অাদিম বর্বর জীবন ছেড়ে মানুষ অালোয় এসেছে। প্রতিষ্ঠা করেছে সমাজ, সভ্যতা, শহর-নগর-বন্দর। কিন্তু প্রকৃত অর্থেই কি মানুষ সভ্য হয়েছে? কমেছে কি বর্ণবৈষম্য কিংবা লিঙ্গবৈষম্য? বন্ধ হয়েছে কি মানুষে মানুষে হানাহানি, মারামারি ও রক্তপাত?
ইসলামে বর্ণবাদের জায়গা নেই। সাদা-কালোর শান্তিময় সহাবস্থানের অনন্য ভিত্তি স্থাপন করেছে ইসলাম যেখানে সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র নাগরিক- সৈনিক, শাসক-শাসিত কিংবা রাজা আর প্রজা সকলেই সমান মর্যাদার অধিকারী। কুরআন ও হাদিসে বর্ণবাদিতা ও গোত্র প্রাধান্যকে নিষেধ করা হয়েছে। দেশ, কাল, ওপাত্র ভেদে মানুষে মানুষে বর্ণের যে ভিন্নতা অার ভাষাগত বিভাজনকে মহান আল্লাহ তাঅালার অন্যতম নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরঅানে আল্লাহ তাআলা বলেন-‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও তোমাদের বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য।’ (সুরা রুম : আয়াত ২২)
চির শান্তির ধর্ম ইসলাম ধর্ম বিশ্বাস, গাত্রবর্ণ, বংশ মর্যাদা, ও পেশীশক্তির অহঙ্কারবশত কোনো ব্যক্তি বা জাতি কর্তৃক নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করাকে কখনোই সমর্থন করেনি। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে– ‘হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের একজন নারী ও একজন পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত, যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সব কিছুর খবর রাখেন। (সুরা হুজরাত : আয়াত ১৩)
অাল্লাহ তাঅালা অারও বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সঙ্গে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান হও। কোনো জাতির প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদের কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ করো, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর; আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা আল-মায়িদাহ : আয়াত ৮)
বর্ণবাদী আচরণের কোনো সুযোগই দেয়নি ইসলাম। কে সাদা, কে কালো; কে ধনী কিংবা কে গরিব এবং শ্রেষ্ঠ-নিকৃষ্টের পার্থক্য করার কোনো অবকাশ নেই। হাদিসে এসেছে-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের, কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের উচ্চ মর্যাদা নেই। একজন শ্বেতাঙ্গ একজন কৃষ্ণাঙ্গের তুলনায় এবং একজন কৃষ্ণাঙ্গ একজন শ্বেতাঙ্গের তুলনায় উচ্চতর নয়। পার্থক্য শুধু মানুষের চরিত্র ও কর্মের মাধ্যমে।’
বিদায় হজ্জ্বের সেই ঐতিহাসিক ভাষণে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মান মর্যাদার মাপকাঠী কী হবে তা বলেছেন, ‘হে লোক সকল! তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহ তাআলার কাছে অধিকতর সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী; যে অধিক তাকওয়া অবলম্বন করে, সব বিষয়ে আল্লাহর কথা অধিক খেয়াল রাখে।’
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিষয়ে অারও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘মানুষ দেখতে যতবেশি সুন্দরই হোক না কেন, তার মধ্যে যদি আল্লাহর ভয় না থাকে, উত্তম আমল না থাকে; কুরআন-সুন্নাহর আমল না থাকে তবে সে ব্যক্তি কখনোই শ্রেষ্ঠ হতে পারে না।‘
বর্ণবাদের ইতিহাস নতুন কোনো ইতিহাস নয় এমনকি হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাও নয়। বহুবার বহুভাবে পৃথিবীতে বর্ণবৈষম্যজনিত বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে, আহত-নিহত হয়েছে বহু মানুষ। কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ— বিভেদটা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। বর্ণবাদী এ যুদ্ধে মানুষের গায়ের রঙেই বেশি চিহ্নিত হয় অার এ বর্ণবৈষম্যের কারণেই সাদা-কালো মারা-মারি, হানাহানি কিংবা প্রাণহানির মতো নিকৃষ্ট ঘটনার জন্ম নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ বর্ণবৈষম্যের কারণে বহু মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে যুযে যুগে। ফুটবল, ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলাধুলায়ও হরহামেশাই দেখা যায় ঘৃণ্য এই অাচরণের।
আধুনিক এই সভ্য সমাজেও কেন ঘটে বর্ণবৈষম্য? জাহেলি বা বর্বর যুগের সাথে পার্থক্যটা তাহলে রইলো কোথায়? সভ্য যুগের মানুষ কেন এমন অসভ্য হবে? উত্তর কি জানা অাছে কারও? বর্ণবাদী মানুষের দাম্ভিকতায় আজও প্রাণ হারায় অগণিত মানুষ।কেউ কি বলতে পারে প্রকৃত সভ্য জগতে কবে প্রবেশ করব অামরা? সকলেই স্বীকার করেন সাদা বা কালো হয়ে জন্মানোর মাঝে তার কোনো কৃতিত্ব নেই, তার নেই কোনো হাত অাবার সেই মানুষজনই কেন দ্বিধাবোধ ভিন্ন আবরণের অন্য কোনো মানুষ তার গা ঘেষে দাঁড়ালে?
গাত্রবর্ণের ভিন্নতার কারণে কোনো জনগোষ্ঠী সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করাকে বর্ণবাদ বলা হয়। বর্ণবাদ মানেই বর্ণবৈষম্য অার সাদা কালোয় ভেদাভেদ। হাল জমানায় এই বর্ণবাদ কেবল গাত্রবর্ণের বৈষম্যের মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই বরং ছড়িয়ে পড়েছে জাতি-গোষ্ঠী, দেশ-শ্রেণী, ধর্ম বিশ্বাস এমনকি সমাজের সর্বক্ষেত্রে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন হয়েছে বহুবার।বর্ণবৈষম্য দূরীকরণে আইন হয়েছে, হয়েছে নীতিমালাও এমনটি গঠিত হয়েছে বিভিন্ন সংগঠন-কমিশনও। কিন্তু থেমেছে কি এই বর্ণবৈষম্য? মানুষ কেন মেনে নিতে পারছে না জন্মগত ভিন্নতার এই আবরণকে? মানবরচিত কোনো বিধান কিংবা নীতিমালায় নয়; বর্ণবাদের এই বৈষম্য দূরীকরণে ইসলামই দিয়েছে একমাত্র সমাধান ও কর্যকরী ফমূর্লা। ইসলামে কোনো বর্ণবৈষম্য নেই। বর্ণবাদকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না ইসলাম; বর্ণবাদকে নির্মূল করে আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অনন্য এক উদাহরণ প্রতিষ্ঠিত করতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন করেছেন ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সা.)। তিনি সফল হয়েছেনও। এখন অামরা যদি তাঁর দেখানো পথে না চলি, তাঁর উপদেশ গ্রহণ না করি সেটা অামাদের সমস্যা।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি বর্ণগত সৌন্দর্য বা জাতি-বংশগত উঁচুতা নয়। বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে রাসুল (সা.) স্পষ্টভাষায় বলেছেন, ‘হে মানবসকল! তোমাদের পালনকর্তা এক আল্লাহ। তোমাদের আদি পিতা এক আদম (আ.)। মনে রেখো! অনারবের ওপর আরবের ও আরবের ওপর অনারবের এবং শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের ও কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনোই বিশেষত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শুধু আল্লাহভীতি ও ধর্মপালনের দিক দিয়েই এ বিশেষত্ব বিবেচিত হতে পারে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং- ২২৯৭৮)
কুরঅানের এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তুমি কি দেখো না, আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত করেন; আর আমি তা দ্বারা বিচিত্র বর্ণের ফলমূল উদ্গত করি। আর পাহাড়ের মধ্যে রয়েছে বিচিত্র বর্ণের পথ- শুভ্র, লাল ও নিকষ কালো। এভাবে আরো রয়েছে রংবেরঙের মানুষ, কীটপতঙ্গ ও জন্তু।’ (সুরা ফাতির, আয়াত— ২৭-২৮) সুতরাং বর্ণের ভিন্নতায় মানুষের কোনো হাত নেই। বর্ণের ভিন্নতা বা বৈচিত্রের জন্য মানুষকে দায়ী করা বোকামি ছাড়া অন্য কিছু নয়। এছাড়া হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেহারা-সুরত, ধন-সম্পদের দিকে তাকান না; কিন্তু তিনি তোমাদের কর্ম ও অন্তরের অবস্থা দেখেন।’
লেখক: মো. মিকাইল আহমেদ
শিক্ষার্থী, আইসিএমএবি, ঢাকা